রাজবাড়ী প্রতিনিধিঃ- রাজবাড়ী পাংশা উপজেলার একসময়ের প্রাণবন্ত উঠোন আজ নিস্তব্ধ। হাসি-আনন্দের জায়গায় শোনা যায় শুধু শিকলের ঝনঝনানী শব্দ আর বেঁচে থাকার করুন আর্তনাদ। পাংশা উপজেলার মেঘনা মোল্লা পাড়ার এক গৃহে প্রতিদিনই প্রতিধ্বনিত হয় শিকলের ঝনঝন শব্দ। সে শব্দ কারো কাছে কেবল অনীহা ও ধাতব কিন্তু বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কাছে সেটি কেবল বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস এবং নিরুপ যন্ত্রণা। অসহায় বাবা-মায়ের অপুরণীয় স্বপ্ন আর দুটি তরুণ প্রাণের দীর্ঘশ্বাস। এক সময় প্রাণবন্ত, হাসিখুশি, স্বাভাবিক দুই তরুণ-তরুণী আজ লোহার শিকলে বন্দি। এই করুণ বাস্তবতার নাম জালাল মোল্লা (৩৫) ও তার বোন হাজেরা খাতুন (২৭)।
একসময় জালাল ছিলেন পরিবারের ভরসা। কৃষিকাজ করতেন, হাসি-আনন্দে ভরে থাকত সংসার। কিন্তু প্রায় এক দশক আগে হঠাৎই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। পরিবার তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে নেয়, শুরু হয় চিকিৎসা, কিন্তু অর্থাভাবে থেমে যায় সবকিছু। বাড়ি ফিরে জালাল হয়ে ওঠেন পরিবারের জন্য আতঙ্ক—কখনো নিখোঁজ হতেন, কখনো নির্দয়ভাবে সবাইকে আঘাত করতেন। শেষমেশ নিরুপায় বাবা-মা নিজের হাতেই প্রিয় সন্তানকে শিকলে বেঁধে রাখতে বাধ্য হন।অন্যদিকে হাজেরার জীবনও থেমে যায় এক নির্মম দুর্ঘটনায়। বিয়ের পর কোলে আসে সন্তান। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে শিশুটি পানিতে ডুবে মারা যায়। প্রিয় সন্তানের মৃত্যু মেনে নিতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারান হাজেরা। সংসার ভেঙে যায়, ভেঙে যায় তার সব স্বপ্ন। একসময় যে হাত দিয়ে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে রাখতেন, আজ সেই হাতও লোহার শিকলে বাঁধা।
এই দুই ভাইবোনের জীবনের সবচেয়ে বড় অবলম্বন এখন বৃদ্ধ মা-বাবা।কান্নাজড়িত কণ্ঠে মা আকিরন বেগম বলেন, আমার ছেলে মেয়ে দু’জনেই মাঝে মাঝে আমাকে মারধর করে। শরীরজুড়ে কত আঘাত সইতে হয়, তা কাউকে বলা যায় না। তবুও তারা তো আমার সন্তান! ক্ষুধার্ত থাকবে—এই কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না। রান্না করে ঘরে রেখে দিই, যখন ইচ্ছা তখন খেয়ে নেয়। যত কষ্টই দিক না কেন, মা তো মায়েই।”বাবা ফজাই মোল্লার কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে, “আমার ছেলে একসময় মাঠে কঠোর পরিশ্রম করত, সংসারের ভরসা ছিল। হঠাৎ মানসিক সমস্যা শুরু হলো। মানসিক সমস্যা শুরু হলে তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে নিয়েছিলাম। চিকিৎসা করাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু টাকার অভাবে পারিনি। ফিরিয়ে আনতেই হলো। এরপর বাড়িতে থাকতে থাকতে অবস্থা আরও খারাপ হয়। কখনো বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত, কখনো সবাইকে মারধর করত। শেষে নিরুপায় হয়ে নিজের সন্তানকে শিকলে বেঁধে রাখতে হয়েছে। ভাবুন তো, কোন বাবা-মা সন্তানের পায়ে শিকল পরাতে চায়?”এলাকাবাসী বলেন, ওরা একসময় স্বাভাবিক জীবন কাটাত। এখনো যদি চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হয়, তবে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই—তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ দিন এ বিষয়. পাংশা উপজেলা নির্বাহী অফিসার এস. এম. আবু দারদা বলেন, এই ভাইবোন প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। তবে এর বাইরে সহায়তা প্রয়োজন হলে পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করতে হবে। আবেদন পেলে আমরা যথাসাধ্য সহযোগিতা করবো বলে জানান তিনি।
প্রকাশক ও সম্পাদক মোঃ আক্তার হোসেন, মোবাইল০১৬৩১৩২৭৮৭০।
All rights reserved © 2025 somoyprotikkhon.com